নিজস্ব প্রতিবেদন | ২ আগস্ট ২০২৫ |শনিবার
বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশের তরুণ প্রজন্ম এক ধরনের গভীর হতাশা ও উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলন এবং তার পরবর্তী রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে প্রশাসনিক স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় আঘাত লেগেছে দেশের যুব জনগোষ্ঠীর ওপর—যারা দীর্ঘদিন ধরে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবহেলিত।
আন্দোলন থেকে অস্থিরতা
গত বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শিক্ষিত তরুণ সমাজ। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন দ্রুতই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও যুবক রাস্তায় নেমে আসে, এবং আন্দোলনের চাপে তৎকালীন সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক ক্ষমতা গ্রহণ করে। যদিও অনেকেই মনে করেছিলেন এই পরিবর্তন নতুন আশার দ্বার খুলে দেবে, বাস্তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে যায়।
বেকারত্বের ক্রমবর্ধমান হার
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের যুব বেকারত্বের হার বর্তমানে ১৫ শতাংশেরও বেশি। বিশেষ করে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ হার সবচেয়ে বেশি। বহু তরুণ উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার পরও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দুই থেকে তিন বছর চাকরির সন্ধানে কাটালেও কোনো সাক্ষাৎকার পর্যন্ত পাচ্ছেন না অনেকে।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক রাকিব হোসেন বলেন, “আমার মতো হাজার হাজার তরুণ প্রতিদিন আবেদন করছে, কিন্তু খবরই নিচ্ছে না কেউ। মনে হচ্ছে পড়াশোনা করেও কোনো লাভ হলো না।” শুধু পুরুষ নয়, নারীরাও একই সংকটে আছেন। নারীদের যুব বেকারত্বের হার পুরুষদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতে কাজ করা অনেক নারী কর্মী সাম্প্রতিক সময়ে চাকরি হারিয়ে ঘরে বসে আছেন।
অর্থনৈতিক ও নীতিগত সংকট
এই পরিস্থিতির পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী দুর্বলতাও একটি বড় কারণ। অন্তর্বর্তী সরকার কিছু সংস্কার আনার ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ধীরগতির এবং প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে আছে। নতুন শিল্পে বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে, উদ্যোক্তারা ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহ হারিয়েছেন এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন।
শিক্ষা ও চাকরির বাজারের অসামঞ্জস্য
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এবং চাকরির বাজারের চাহিদার মধ্যে গভীর অসামঞ্জস্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ পেলেও অনেক শিক্ষার্থী বাস্তব জীবনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে চাকরিদাতারা উপযুক্ত প্রার্থী পেলেও তাদের কাজে নিতে পারছেন না। এতে শিক্ষিত বেকারত্বের হার ক্রমেই বাড়ছে।
উদাহরণস্বরূপ, প্রযুক্তি, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স, ও নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা থাকলেও, এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার সুযোগ সীমিত। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো তত্ত্বভিত্তিক পাঠক্রম আধিপত্য করছে, যা বাস্তব কাজের চাহিদা মেটাতে অক্ষম।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা। স্থিতিশীল পরিবেশ ছাড়া নতুন বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি সম্ভব নয়। এর পরের ধাপে প্রয়োজন দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষার সম্প্রসারণ।
তারা আরও প্রস্তাব করেন—
- স্থানীয় শিল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংযোগ স্থাপন: বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমে শিল্পখাতের চাহিদা অন্তর্ভুক্ত করা।
- বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম: যাতে শিক্ষার্থীরা স্নাতক সম্পন্নের আগেই বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।
- স্টার্টআপ সহায়তা: উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ ও ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা।
- কর্মসংস্থানভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতি: যাতে শিল্পখাত ও সেবা খাত উভয় ক্ষেত্রেই নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়।
যুব সমাজের ভবিষ্যৎ ও জাতীয় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশই তরুণ, যা দেশের জন্য “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড” হতে পারে। কিন্তু এই বিপুল মানবসম্পদ যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো না হয়, তবে তা সামাজিক অস্থিরতা, মেধা পাচার ও অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
যুবসমাজের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে এখনই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি সংস্কার, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি শিক্ষা, এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ—এসব মিলেই গড়ে উঠতে পারে একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ। নতুবা বর্তমান হতাশা আরও গভীর হয়ে ভবিষ্যতে জাতীয় সংকটে রূপ নিতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ