নিজস্ব প্রতিবেদন | ৭ আগস্ট ২০২৫|বৃহস্পতিবার
পাঁচ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে উদ্দীপনা ও উৎসাহের মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পালিত হয়েছে। ঠিক একই দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করেন এবং বহুল আলোচিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন। এসব পদক্ষেপ দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের আশাবাদ তৈরি করলেও, গত এক বছরে অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্যগুলো কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে—সেই প্রশ্ন এখনো প্রাসঙ্গিক।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এখনও অনেক পথ বাকি। রাজনৈতিক সংস্কারে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর প্রভাব সীমিত; দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং প্রভাব খাটানোর মতো কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়নি—শুধু ব্যক্তিবদল ঘটেছে। অর্থাৎ, পুরনো কুশীলবদের জায়গায় নতুন মুখ এসেছে, কিন্তু আচরণ ও প্রবণতায় তেমন পরিবর্তন দেখা যায়নি।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব স্পষ্ট। আগে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন যেভাবে দখলদারি, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে জড়িত ছিল, এখন তার অনুরূপ চিত্র দেখা যাচ্ছে অন্যান্য দলেও। এতে বোঝা যায়, কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক সংস্কার শুধু শীর্ষ পর্যায়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নয়, বরং তৃণমূল পর্যায়ে আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমেই সম্ভব। এই পরিবর্তন না এলে অভ্যুত্থানের মূল চেতনা পূর্ণতা পাবে না।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। পূর্ববর্তী সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং পরবর্তীতে সাইবার নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচনাকারীদের দমনে সক্রিয় ছিল। ক্ষমতার পরিবর্তনের পর এসব আইনের অপব্যবহার কিছুটা কমলেও নতুন ধরনের হুমকি তৈরি হয়েছে—যেমন, সংবাদমাধ্যমের কার্যালয় দখল, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপ, এবং সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করার মতো ঘটনা। ফলে, সাংবাদিকরা তাদের কাজে পূর্ণ স্বাধীনতা অনুভব করছেন না। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের পাশাপাশি অনলাইন মিডিয়াও চাপের মুখে পড়ছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও নির্বাচন সংস্কারে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে কিছু নীতি প্রণয়ন করা হলেও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও দলীয় প্রভাব পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা এবং দুর্নীতির অভিযোগও এখনো বিদ্যমান।
টিআইবির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক সরকার গঠনের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা পূর্ণতা পায়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে পুরনো সমস্যাগুলো নতুন রূপে দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা, প্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ প্রয়োজন।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বৃদ্ধি। বিগত এক বছরে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করার প্রবণতা বেড়েছে। এর ফলে সহিংসতা ও সামাজিক মেরুকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নারীর অধিকার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সহিংসতার ঘটনা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করা—এসব প্রবণতা সমাজে বৈচিত্র্য ও সহনশীলতার পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে।
তবে সবকিছু নেতিবাচক নয়। কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় কিছু জায়গায় স্বচ্ছতা ও জনঅংশগ্রহণ বেড়েছে, দুর্নীতির অভিযোগে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির তৈরি হয়েছে, এবং জনসেবায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব পদক্ষেপ ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনাময়, তবে এগুলোকে টেকসই করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
পরিশেষে বলা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরে কিছু অগ্রগতি হলেও মূল লক্ষ্য ও চেতনায় পুরোপুরি পৌঁছানো যায়নি। গণতান্ত্রিক রূপান্তর, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আরও গভীর ও ধারাবাহিক সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচনের প্রাক্কালে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে—প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সংবাদমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান, রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, এবং দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। কেবল এভাবেই জুলাই অভ্যুত্থানের মূল চেতনা বাস্তবে রূপ পাবে এবং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও সুদৃঢ় হবে।
আরও পড়ুন
জুলাই ঘোষণাপত্রে পক্ষপাত ও ইতিহাস বিকৃতি: বার্গম্যানের সমালোচনা
৫ আগস্টের ঢাকায় ইতিহাসের মোড় ঘোরানো দিন: কারফিউ ভেঙে রাজপথে জনতার জোয়ার
যা কেউ কল্পনাও করেনি, সেই ঘটনার বিচার শুরু: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের মামলা!
0 মন্তব্যসমূহ