add

সর্বশেষ জাতীয় আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিনোদন খেলাধুলা তথ্যপ্রযুক্তি স্বাস্থ্য ইসলাম শিক্ষা জীবনধারা

জুলাই ঘোষণাপত্রে পক্ষপাত ও ইতিহাস বিকৃতি: বার্গম্যানের সমালোচনা

নিজস্ব প্রতিবেদন | ৬ আগস্ট  ২০২৫ | বুধবার 

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশিষ্ট সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান কঠোর সমালোচনা জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি এক বিস্তারিত পোস্টে দাবি করেন, ঘোষণাপত্রটি ইতিহাসকে পক্ষপাতদুষ্ট ও একপেশে উপস্থাপন করেছে এবং এতে স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর মতে, এই দলিলটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সময়কে বিকৃতভাবে তুলে ধরে যা জাতির ঐক্যবদ্ধ চেতনায় অন্তরায় হতে পারে।

বার্গম্যান বলেন, ঘোষণাপত্রে যেভাবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের সময়কাল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ একটি পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে জাতি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। একদিকে মাত্র একদলীয় শাসনের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যেসব ইতিবাচক অবদান রয়েছে, যেমন জাতির পুনর্গঠন, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসন, সেগুলো একেবারেই আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে। বিশেষত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ঘোষণাপত্রে কোনো উল্লেখ না থাকার বিষয়টি বার্গম্যান গভীরভাবে দুঃখজনক মনে করেন। তিনি বলেন, ঐ ঘটনার প্রভাব ছিল দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং তা জাতির পথ পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।

বার্গম্যান আরও বলেন, পরবর্তী সেনাশাসনের সময়কালের বিবরণও কুৎসিত ও পক্ষপাতমূলকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ২০০৭ সালের ১/১১ সেনা-সমর্থিত সরকার গঠনের পেছনে যে ষড়যন্ত্র ছিল বলে ঘোষণাপত্র উল্লেখ করেছে, সেটি তার দৃষ্টিতে ভুল ও ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে রচিত। তিনি বলেন, ঐ সময়কার রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ অনেকেই গ্রহণযোগ্য মনে করেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনও দেশের ইতিহাসের অন্যতম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিল, কিন্তু ঘোষণাপত্রে সেটিকে বিতর্কিত ও সন্দেহজনক করে দেখানো হয়েছে, যা সত্যের সাথে খাপ খায় না।

ডেভিড বার্গম্যানের মতে, ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে দেশ যে অগ্রগতি করেছে, তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রবৃদ্ধি করেছে, নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এসব অর্জনের কথা একেবারেই বিবৃতিতে নেই। বরং দলটিকে ‘ফ্যাসিস্ট’, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ ও ‘গণবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করে একতরফা ও নেতিবাচক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যা একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

বিশেষ করে বার্গম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ইউনূস যদি সত্যিই রাজনীতির বাইরে থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য হন, তাহলে এ ধরনের বিতর্কিত রাজনৈতিক দলিলের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত করা তাঁর নিরপেক্ষতা ও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বার্গম্যান মনে করেন, জাতির বিবাদ ও বিভাজন বাড়ানোর পরিবর্তে ঐতিহাসিক দলিলগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে তৈরি করা উচিত।

তবে তিনি ঘোষণাপত্রের কিছু ইতিবাচক দিকও উল্লেখ করেন। যেমন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব এবং জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, আন্দোলনে নিহত শহিদদের স্বীকৃতি দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা। এগুলো দেশবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ডেভিড বার্গম্যান শেষবারে বলেন, ইতিহাসের একটি পক্ষপাতমূলক দলিল তৈরি করে জাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা সঠিক নয়। তিনি মনে করেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ যদি আরও সংক্ষিপ্ত, তথ্যভিত্তিক এবং নিরপেক্ষভাবে লেখা হতো, তাহলে তা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অনেক বেশি সহায়ক হতো। কারণ জাতির ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিহাসের পক্ষপাতমুক্ত ও পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপনা অপরিহার্য। তিনি সবাইকে আহ্বান জানান, অতীতকে সামগ্রিকভাবে বোঝা এবং ভবিষ্যতের জন্য একত্রিত হওয়া, যাতে দেশের গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।

সার্বিকভাবে ডেভিড বার্গম্যানের এই সমালোচনামূলক বক্তব্য বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও ইতিহাস পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তার কথাই প্রতিফলিত করছে। তিনি মনে করেন, ইতিহাস বিকৃত করা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এবং জাতির মাঝে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। তাই দেশের ভবিষ্যতের জন্য ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে, বৈচিত্র্যময় ও সমন্বিত দৃষ্টিতে উপস্থাপন করাই উত্তম পথ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ