নিজস্ব প্রতিবেদন |১২ আগস্ট ২০২৫,মঙ্গলবার
শুরু হয়েছে ইলিশ মৌসুম, আর সেই সাথে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে উপকূলের মৎস্যজীবী সমাজ। যদিও আবহাওয়া সবসময় অনুকূলে নেই, তবুও বৈরী সাগর ও তীব্র বাতাসও তাদের মনোবল ভাঙতে পারছে না। সাগরপাড়ের মানুষের জীবন জুড়েই আছে মাছ ধরা, আর ইলিশ মৌসুম তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাই উত্তাল সাগরের ঢেউকে উপেক্ষা করেই উত্তর কাট্টলী সাগরপাড় থেকে ছোট লাল রঙের নৌকাগুলো একে একে ছুটে চলেছে বিশাল সমুদ্রের বুকে—লক্ষ্য একটাই, রুপালি ইলিশ ধরা।
সকালের প্রথম আলো ফোটার সাথে সাথে সাগরপাড়ের চিত্র হয়ে ওঠে কর্মব্যস্ত। মৎস্যজীবীরা তখন নৌকা সাজানো, জাল গুছানো, বরফ ভর্তি করা, ইঞ্জিন পরীক্ষা এবং ইঞ্জিন তেল ভরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ দড়ি ভাঁজ করছেন, কেউ আবার জাল ঠিকঠাক করছেন, যাতে সমুদ্রে গিয়ে সময় নষ্ট না হয়। প্রতিটি নৌকায় থাকে বরফের স্তূপ—ধরা মাছ তাজা রাখতে এটি অপরিহার্য। আবার কেউ কেউ যাচ্ছেন বাজার থেকে শেষ মুহূর্তে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে আনতে। ছোট নৌকাগুলো একে একে পাড় ছাড়ছে, যেন সাগরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে চলেছে তারা।
যদিও আবহাওয়া প্রতিকূল, তবে মৎস্যজীবীদের জন্য এই মৌসুম খুবই সীমিত সময়ের। বছরের অন্য সময়ে সমুদ্রে ইলিশের দেখা মিললেও এই সময়ে পরিমাণে অনেক বেশি থাকে। তাই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারা সাগরে যেতে দ্বিধা করেন না। ইলিশ শিকার শুধু তাদের আয়ের উৎস নয়, বরং এটি তাদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি ধরা ইলিশ মানে পরিবারের খাবার, সন্তানদের পড়ালেখার খরচ, ঘরের দৈনন্দিন ব্যয় মেটানো—সবই এই রুপালি মাছের উপর নির্ভর করে।
সাগরের দিকে নৌকা ছাড়ার দৃশ্য যেন এক রোমাঞ্চকর অথচ কঠিন যাত্রার শুরু। সাগরের পানির রং ধূসর হয়ে আছে, দূরে ঢেউ উঁচু হয়ে উঠছে, আর বাতাসের শব্দে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। নৌকাগুলো ছোট হলেও প্রতিটিতে থাকে দৃঢ় মনোবল আর অভিজ্ঞ হাতে চালনার দক্ষতা। একজন মৎস্যজীবী জাল ফেলছেন, আরেকজন ইঞ্জিনের শব্দ শুনে নিশ্চিত হচ্ছেন সব ঠিক আছে কিনা। যাত্রার শুরুতেই তারা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিচ্ছেন—যেন সাগরের এই যুদ্ধে সবাই একে অপরের সহযোদ্ধা।
নৌকাগুলো দূরে চলে গেলে সাগরপাড়ে থেকে যায় পরিবারের উদ্বিগ্ন মুখগুলো। মা, স্ত্রী, সন্তানরা জানে সমুদ্রে যাওয়া মানেই ঝুঁকি, কিন্তু জীবিকার তাগিদে এই পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারা প্রার্থনা করে, যেন সাগর শান্ত থাকে, আর প্রিয়জন নিরাপদে ফিরে আসে ভালো মাছ নিয়ে।
এই মৌসুমে ইলিশ শিকার শুধু ব্যক্তিগত জীবিকা নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং দেশের মাছ রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ এর উপর নির্ভরশীল। প্রতিদিন হাজার হাজার মণ ইলিশ উপকূল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। বাজারে ইলিশের সরবরাহ বজায় রাখতে এবং দাম স্থিতিশীল রাখতে এই মৌসুমে মৎস্যজীবীদের অবদান অপরিসীম।
মৎস্যজীবীরা শুধু মাছ ধরছেন না, বরং দেশের মৎস্যসম্পদ সুরক্ষায়ও তারা ভূমিকা রাখছেন। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, নিষিদ্ধ সময়ে তারা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকেন এবং ডিমওয়ালা ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে সচেতন থাকেন। অনেকেই এখন আধুনিক জাল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, যাতে ছোট মাছ বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ইলিশ ধরা না পড়ে। এটি মাছের প্রজনন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
তবে বৈরী আবহাওয়ায় সমুদ্রে যাওয়া সহজ কাজ নয়। প্রবল ঢেউ, তীব্র বাতাস, হঠাৎ ঝড়ের আশঙ্কা—সবই মৎস্যজীবীদের প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ। এজন্য তারা আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কতা ও সাগরের পরিস্থিতি নজরে রাখেন। অনেকেই নৌকায় জীবনরক্ষাকারী জ্যাকেট ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম রাখছেন, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে প্রাণহানি এড়ানো যায়।
ছবিতে দেখা যায়, কেমন করে মৎস্যজীবীরা জাল গুছিয়ে নিচ্ছেন, দড়ি ভাঁজ করছেন, বরফ ভর্তি করছেন, আর ছোট ছোট নৌকাগুলো একে একে সাগরে নামাচ্ছেন। প্রতিটি মুহূর্তে তাদের চোখে ফুটে ওঠে প্রত্যাশা—ফিরে আসার সময় নৌকাভর্তি ইলিশ নিয়ে আসবেন তারা। এই দৃশ্য শুধু একটি পেশার গল্প নয়, বরং এটি সাহস, পরিশ্রম ও জীবিকার জন্য অবিরাম সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
দিন শেষে যখন তারা ফিরে আসেন, তখন সমুদ্রের লোনা জল, সূর্যের তাপ ও ক্লান্তির ছাপ তাদের শরীরে স্পষ্ট থাকে। কিন্তু যদি নৌকাভর্তি ইলিশ থাকে, তবে সেই ক্লান্তি মিলিয়ে যায়। কারণ তারা জানেন, এই রুপালি ফসলই তাদের পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখে, আর দেশের বাজারে সরবরাহ বজায় রাখে।
এভাবেই উত্তাল সাগর ও বৈরী আবহাওয়ার সাথে লড়াই করে মৎস্যজীবীরা প্রতিদিন নতুন দিনের শুরু করেন। তাদের ঘামে ভিজে থাকা পরিশ্রম শুধু একটি মাছ ধরা নয়—এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি টানা দুই বছর নিম্নমুখী, নতুন বাজারে সম্ভাবনা।
বিবাহবিচ্ছেদের দিনেই ট্রাম্প ডেটের প্রস্তাব দিয়েছিলেন: এমা টমসন।
0 মন্তব্যসমূহ