আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে ভারত বহু বছর ধরেই কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল অবলম্বন করে আসছে। একদিকে তারা নিরপেক্ষ অবস্থান সামনে আনে, অন্যদিকে বাস্তববাদী কূটনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। নতুন জোট গঠন, শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক প্রভাবের পুনর্বিন্যাসের মধ্যে ভারতকে এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি কূটনৈতিক চাপে পড়তে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র: সুযোগের পাশাপাশি অস্বস্তিও
ভারতের দীর্ঘদিনের কৌশলগত অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে ওয়াশিংটন ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েনও তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় রপ্তানি খাতে বড় ধাক্কার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ভারত কিছুটা হতাশ হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের নরম মনোভাব দিল্লির কাছে অস্বস্তিকর। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির যুক্তরাষ্ট্র সফরে কাশ্মীর ইস্যুতে উসকানিমূলক বক্তব্য দিলেও ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। এতে ভারতের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে, মার্কিন নীতি এখন অনেক বেশি স্বার্থকেন্দ্রিক।
চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা: প্রধান উদ্বেগ
চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে চীন পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী। সাম্প্রতিক চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) প্রকল্প দুই দেশের বন্ধুত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, আর চীনের প্রত্যক্ষ সমর্থন সেই হুমকিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
কাশ্মীর সীমান্তে সন্ত্রাসী হামলা, লাদাখ সীমান্তে চীনের আগ্রাসন এবং পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে ভারতকে একসঙ্গে দুই দিক থেকে চাপে পড়তে হচ্ছে।
রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধন
শীতল যুদ্ধকাল থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর। প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়া ভারতের সবচেয়ে বড় অংশীদার। যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে উন্নত অস্ত্র সরবরাহ—সবক্ষেত্রেই রাশিয়া ভারতের পাশে থেকেছে। তবে মস্কোর চীনের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা দিল্লির কাছে শঙ্কার কারণ হয়ে উঠছে।
ইউরোপ, আফ্রিকা ও উপসাগরীয় অঞ্চল: নতুন দিগন্ত
চীনের প্রভাব এড়িয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো ভারতকে বিকল্প অংশীদার হিসেবে দেখছে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা এবং ফ্রান্স-জার্মানির আগ্রহ ভারতকে নতুন সুযোগ এনে দিচ্ছে।
একইভাবে আফ্রিকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়ছে। উপসাগরীয় অঞ্চল ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে প্রায় আট মিলিয়ন ভারতীয় কর্মরত আছেন, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স ভারতের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি সহযোগিতায়ও গালফ দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছে।
জাপান: ইন্দো-প্যাসিফিকের ঘনিষ্ঠ মিত্র
জাপান বহুদিন ধরেই ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন। বর্তমানে ভারত আশা করছে, সেই ধারা অব্যাহত থাকবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের উত্থান ঠেকাতে দিল্লি-টোকিও ঘনিষ্ঠতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ভারতের করণীয়
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের সামনে কিছু জরুরি করণীয় রয়েছে—
সীমান্ত নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কঠোর অবস্থান
অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষায় সক্ষমতা বাড়ানো
অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা ও বাণিজ্যে বৈচিত্র্য আনা
নীতিনির্ভর বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নেওয়া
আন্তর্জাতিক অস্থিরতার এই সময়ে ভারত এক কঠিন কূটনৈতিক ভারসাম্যের খেলায় রয়েছে। প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র, অস্ত্রে রাশিয়া, বাণিজ্যে ইউরোপ, উন্নয়ন ও প্রবাসীদের স্বার্থে আফ্রিকা ও উপসাগরীয় অঞ্চল—সব জায়গায়ই সক্রিয় ভূমিকা রাখছে দিল্লি। তবে কঠোর জোটে না গিয়ে নমনীয় কূটনীতি বজায় রাখাই এখন ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই ভারসাম্য ধরে রাখতে হলে আরও স্পষ্ট কৌশল ও দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
আরও পড়ুন
১.বিজেপিকে ফ্যাসিস্ট বলায় থালাপতি বিজয়ের নামে মামলা
২.আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিয়ে দিল্লির প্রতিক্রিয়া
৩.হোয়াইট হাউসে বৈঠকের মাঝেই ট্রাম্প–পুতিন ফোনালাপ
0 মন্তব্যসমূহ