গাজায় টানা হামলায় নিহতের সংখ্যা ৬২ হাজার ছাড়াল

নিজস্ব প্রতিবেদন |১৯ আগস্ট ২০২৫,মঙ্গলবার 

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের টানা বোমাবর্ষণে মানবিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করেছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৪ জনে। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায়ই নতুন করে অন্তত ৬০ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৩৪৪ জন। এ নিয়ে আহতের সংখ্যা এক লাখ ৫৬ হাজার ছাড়িয়েছে।

মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, নিহত ও আহতদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। গাজার হাসপাতালগুলো ইতিমধ্যেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে অথবা সরঞ্জাম ও ওষুধের অভাবে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ফলে চিকিৎসা না পেয়ে অসংখ্য আহত মানুষ ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যুবরণ করছেন।

ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা মানুষ

গাজায় এখনও বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। নিয়মিত বোমাবর্ষণ এবং উদ্ধার সরঞ্জামের সংকটের কারণে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না উদ্ধারকর্মীরা। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা চেষ্টা করলেও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় অনেক মৃতদেহ মাটিচাপা অবস্থায় পড়ে আছে। এর ফলে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে এবং মহামারির ঝুঁকি বাড়ছে।

অনাহার ও অপুষ্টিতে মৃত্যুর মিছিল

যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি বোমায় নিহতদের বাইরে ২৬৩ জন অনাহার ও অপুষ্টির কারণে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই শিশু। গাজা দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকায় খাদ্য ও ওষুধ প্রবেশ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘের উদ্যোগে মাঝে মাঝে কিছু ত্রাণ ঢুকলেও তা মোট জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। ফলে প্রতিদিনই শত শত পরিবার না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। অনেকে অল্প খাবারের সন্ধানে বের হয়ে পড়লেও তারাও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন।

যুদ্ধবিরতি ভাঙার পর আরও ভয়াবহ হামলা

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, চলতি বছরের মার্চ মাসে স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে নতুন করে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বিশেষ করে খাদ্য ও ত্রাণ সংগ্রহে যাওয়া সাধারণ মানুষের ওপর হামলা বেড়েছে। শুধু ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটি স্পষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল।

গাজায় মানবিক বিপর্যয়

গাজা উপত্যকার জনসংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। দীর্ঘদিনের অবরোধ, টানা হামলা, বিদ্যুৎ–পানি ও স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোটা অঞ্চল এক ভয়াবহ মানবিক সংকটে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন গাজায় মানুষের প্রধান হুমকি শুধু বোমাবর্ষণ নয়, বরং অনাহার, রোগব্যাধি ও আশ্রয় সংকট। হাজার হাজার পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটাচ্ছে। বৃষ্টি ও তীব্র গরমে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ভুগছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও আইনি পদক্ষেপ

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর সমালোচনার মুখেও ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত রয়েছে। গত বছর নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা চলছে। তবে এইসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও বাস্তবে হামলা কমেনি।

জাতিসংঘের মহাসচিব একাধিকবার গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রও একই দাবি তুলেছে। কিন্তু ইসরায়েল নিরাপত্তা অজুহাতে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্র ইসরায়েলের অবস্থানকে সমর্থন করায় কার্যকর সমাধান মিলছে না।

শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার

গাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। লাখো শিশু পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত। অনেকেই পরিবারের সদস্য হারিয়ে মানসিক আঘাত নিয়ে বেঁচে আছে। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করেছে যে, একটি প্রজন্ম শিক্ষাহীন হয়ে বড় হলে ভবিষ্যতে গাজার সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে।

অবসানহীন দুঃস্বপ্ন

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি এক অবসানহীন দুঃস্বপ্নের মতো। প্রতিদিন বোমার শব্দ, মৃত্যুর মিছিল ও কান্নায় ভরে উঠছে অঞ্চলটি। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, যদি দ্রুত যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাবে।

এখন প্রশ্ন হলো—বিশ্ব সম্প্রদায় কি শুধু উদ্বেগ জানিয়েই থেমে থাকবে, নাকি সত্যিকারের পদক্ষেপ নেবে? গাজার মানুষ উত্তর খুঁজছে, কিন্তু আপাতত তাদের কপালে শুধুই ধ্বংস, ক্ষুধা আর মৃত্যু লেখা আছে।


আরও পড়ুন 

1.গাজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সিদ্ধান্ত, বিশ্বজুড়ে সমালোচনা

2.হোয়াইট হাউসে বৈঠকের মাঝেই ট্রাম্প–পুতিন ফোনালাপ

3.ট্রাম্পের দাবি, ভারতের ওপর অতিরিক্ত শুল্কে রাশিয়া হারিয়েছে বড় তেল ক্রেতা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ